প্রত্যয় ডেস্ক: ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাসপোর্টকে বিশ্বের অন্যতম আকাঙ্ক্ষিত দলিল হিসেবে মনে করা হয়। এই পাসপোর্টধারীরা ভিন্ন ভিন্ন ২৭টি শান্তিপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ দেশে বসবাস এবং কাজ করতে পারেন। অনেক দেশে চমৎকার সব খাবারও আছে। নাগরিকত্বের জন্মগত লটারিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সিলযুক্ত টিকিটধারীরা সৌভাগ্যবান বিজয়ী।
এর মূল্য নির্ধারণ করা কঠিন হলেও সাইপ্রাস তা ভালোভাবেই সম্পন্ন করেছে। এই দ্বীপ দেশটিতে মাত্র ২ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলেই মিলবে পাসপোর্ট। আর এর মাধ্যমে ইউরোপের নাগরিকত্বের সব সুযোগ-সুবিধা হয়ে যাবে আপনার। সাইপ্রাসের মতো একই ধরনের সুযোগ তৈরি করেছে মাল্টাও। দেশটিতে এক মিলিয়নের বেশি ইউরো বিনিয়োগ করলেই মিলবে পাসপোর্ট।
তবে এভাবে পাসপোর্ট বিক্রিকে ভালো ধারণা বলে মনে করেন না কেউ কেউ। সম্প্রতি এক বক্তৃতায় ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন এ ধরনের সোনালী পাসপোর্টকে ইউরোপে আইনের শাসনের জন্য হুমকি বলে মন্তব্য করেছেন। তার এই বিরক্তির যথেষ্ট কারণও আছে। ইউরোপের একটি পাসপোর্ট নিয়ে যে কেউ চাইলে ইইউ ব্লকের যেকোনও স্থানে যেতে পারেন। সাইপ্রাসের সরকারের দ্রুত অর্থ সংগ্রহের এই পন্থা ইউরোপের অন্যান্য অংশের জন্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।
২০১৩ সালে এই প্রকল্পটি চালু করার পর সাইপ্রাসের সরকার প্রায় ৭ বিলিয়ন ইউরো অর্জন করেছে; যা দেশটির বার্ষিক মোট জিডির প্রায় এক চতুর্থাংশ। দেশটি ভিন্ন মতাবলম্বী ধনীদের কাছে পাসপোর্ট বিক্রি করছে; যারা জার্মানি অথবা ফ্রান্সে এখন স্থায়ী হতে পারেন।
পাসপোর্টের এ ধরনের বিক্রি নিষিদ্ধ করলে তা জনপ্রিয় হতে পারে। কিন্তু এটি সহজসাধ্য কোনও কাজ নয়। কাকে নাগরিকত্ব দেয়া হবে আর কাকে দেয়া হবে না তা নির্ধারণ করার অধিকার ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোর রয়েছে। স্থানীয়দের বিয়ে কিংবা সেদেশে বসবাস করলে ইইউভূক্ত দেশগুলো পাসপোর্ট ইস্যু করতে পারে।
কিছু দেশ ঐতিহাসিক ভুল-ভ্রান্তির খেসারত কিংবা নতুন ভোটার তৈরির জন্য স্বজনদের হাতে পাসপোর্ট তুলে দেয়। নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়টি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাধারণ অধিকার হতে পারে। তবে নাগরিকত্ব দেয়া নিয়ে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে মতভেদ রয়েছে।
অন্যদিকে, কিছু দেশে নাগরিকত্ব দেয়ার ভিন্ন ভিন্ন শর্ত রয়েছে। আয়ারল্যান্ডে কারও দাদা-দাদি থাকলে তিনি আইরিশ নাগরিকত্ব পাবেন। আয়ারল্যান্ডের অনেক নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বসবাস করছে। আইরিশ নাগরিকত্ব পাওয়ার যোগ্য অন্তত ৬০ লাখ মানুষ শুধুমাত্র ব্রিটেনেই আছেন। এই সংখ্যা আয়ারল্যান্ডে বসবাসকারীদের প্রায় ২০ শতাংশের বেশি।
এক্ষেত্রে ইতালি আরও বেশি উদার। ইতালীয় পুরুষ সঙ্গী আছে এমন যে কেউ দেশটির পাসপোর্ট পেতে পারেন। পিতৃতান্ত্রিক সম্পর্ক সূত্র দেশটির নাগরিকত্ব পাওয়ার সর্বোচ্চ কোনও সীমা নির্ধারণ করেনি। ১৯৯৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত ইতালিতে এভাবে নাগরিকত্ব পেয়েছেন প্রায় ১০ লাখ মানুষ। এক পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় ৬ কোটি মানুষ সম্ভাব্য ইতালীয় নাগরিক বিশ্বজুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
তবে অনেক সময় রাজনৈতিক উদ্দেশে পাসপোর্ট দেয়া হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে হাঙ্গেরীর প্রধানমন্ত্রী ভিক্টর অরবানকে একটু বেশি ধূর্তবাজ হিসেবে বলা যেতে পারে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপের সীমান্ত নতুন করে টানা হয়। সার্বিয়া, রোমানিয়ার মতো প্রতিবেশি দেশগুলোতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েন জাতিগত হাঙ্গেরীয়রা। তাদের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ মানুষকে নাগরিকত্ব দেয়ার জন্য আইন সহজ করেন ভিক্টর অরবান।
দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়ে যোশি হারপাজের লেখা বই নাগরিকত্ব ২.০’র তথ্য অনুযায়ী, ২০০১ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রত্যেক বছর অন্তত ১ লাখ ৮০ হাজার মানুষ নতুন করে হাঙ্গেরীর নাগরিকত্ব পেয়েছেন; যা ফ্রান্স এবং জার্মানির নাগরিকত্ব স্বাভাবিকীকরণের চেয়ে বেশি। ভিক্টর অরবানের এই কৌশল বেশ কাজে দিয়েছে; নতুন এই হাঙ্গেরীয়রা নির্বাচনে অরবানকে ব্যাপকভাবে সমর্থন করেন।
প্রায়শ্চিত্তের জন্যও নাগরিকত্ব দেয়ার বিষয়টি একেবারে সাধারণ। স্বাভাবিকভাবে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিষিদ্ধ হলেও ১৯৩০ এবং ১৯৪০ এর দশকে যে ইহুদিরা অস্ট্রিয়া থেকে বহিষ্কৃত হয়েছেন অথবা পালিয়েছিলেন তারা দেশটির পাসপোর্টের আবেদন করতে পারেন। একই ধরনের বিধান রয়েছে জার্মানিতে; যা দেশটির সংবিধানেও নিশ্চিত করা হয়েছে। পনেরো শ’ শতাব্দিতে স্পেন থেকে বিতাড়িত ইহুদিদের বংশধররা বর্তমানে দেশটির নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারেন। কিন্তু সেই সময় বিতাড়িত মুসলিমদের বংশধরদের জন্য এই সুযোগ রাখা হয়নি।
পাসপোর্টকে যদি পণ্য অথবা রাজনৈতিক সামগ্রী অথবা আজীবন নাগরিকত্বের প্রতিশ্রুতি হিসেবে দেখা হয়, তাহলে সেগুলো হস্তান্তর করার জন্য সাধারণ নিয়ম-কানুন তৈরি প্রায় অসম্ভব। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অনেক সদস্য দেশ মাল্টা এবং সাইপ্রাসের সমালোচনা করতে পেরে খুশি। কিন্তু তারা নিজেরা যেভাবে নাগরিকত্ব দেয় তা নিয়ে সমালোচনা হলেও তার প্রশংসা করে না।
কেউ কেউ দ্বৈত নাগরিকত্ব সীমিত করার ধারণার দিকে ঝুঁকতে পারেন। অন্যান্যরা আইরিশ এবং ইতালীয় বংশধরদের অজানা সংখ্যা; যারা ইউরোপীয় ইউনিয়নের নাগরিক হয়ে উঠতে পারেন, তাদের নিয়ে অস্বস্তি বোধও করতে পারেন। তবে মাল্টা এবং সাইপ্রাসের বর্তমান পাসপোর্ট বিক্রির এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে ইইউ।
সোজাসুজি পাসপোর্ট বিক্রি বন্ধের পরিবর্তে মানি লন্ডারিং আইনের মাধ্যমে নতুন আগতদের জীবনকে অতিষ্ট করে তুলতে পারে ব্রাসেলস। কিন্তু অঙ্গীকারাবদ্ধ নির্দিষ্ট রাষ্ট্র এবং কিছু লোভী আইনজীবী এই সোনালি পাসপোর্টের বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারেন।